জুলাই গণ-অভ্যুত্থান: জনগণের হাতে ক্ষমতা চাই, জনগণের সরকার-সংবিধান-রাষ্ট্র চাই’ শীর্ষক এক আলোচনা সভার আয়োজন করে জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল। শনিবার (১৯ অক্টোবর) ঢাকায় জাতীয় প্রেসক্লাবে আয়োজিত এ অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্য দেন বর্ষীয়ান বাম রাজনীতিক, তাত্ত্বিক, লেখক-গবেষক ও বুদ্ধিজীবী বদরুদ্দীন উমর। তিনি জাতীয় মুক্তি কাউন্সিলের সভাপতিও। তাঁর বক্তব্যের গুরুত্বপূর্ণ কিছু অংশ এখানে তুলে ধরা হলো—
হাসিনার সরকারের পতন ভারত হজম করতে পারেনি
ভারত শেখ হাসিনা সরকারের পতন এখন পর্যন্ত হজম করতে পারেনি। এর কারণ, ভারতের সঙ্গে তার প্রত্যেক প্রতিবেশীর সম্পর্ক খারাপ। শুধু বাংলাদেশের ওপর কর্তৃত্ব ছিল। ভারত বাংলাদেশকে আশ্রিত রাজ্যের মতো বিবেচনা করত। সেই আশ্রিত রাজ্য হাত ফঁসকে গেছে।
বাংলাদেশে শেখ হাসিনাকে ক্ষমতায় রাখার জন্য যা যা দরকার ভারত তাই করেছে। শেখ হাসিনাকে আশ্রয় দিয়ে ভারত অস্বস্তিতে আছে। তারা চেষ্টা করেছিল হাসিনাকে অন্য জায়গায় দেওয়ার জন্য। অন্য দেশ আশ্রয় না দেওয়ায় ভারতই রাখল।
আওয়ামী লীগের সব সংগঠন ধসে গেছে
আওয়ামী লীগের সব সংগঠন ধসে গেছে। কেউ যদি মনে করে যে আওয়ামী লীগ আবার ফিরে আসবে…, সেটা একেবারেই অসম্ভব ব্যাপার। ১৯৫৪ সালে মুসলিম লীগ যেভাবে শেষ হয়ে গিয়েছিল, এখন আওয়ামী লীগও সেভাবে শেষ হয়ে গেছে।
চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান ছিল বায়ান্ন সাল থেকে এখন পর্যন্ত সংঘটিত অভ্যুত্থানগুলোর মধ্যে সবচেয়ে ব্যাপক, গভীর ও আক্রমণাত্মক। এর কারণ, গত সাড়ে ১৫ বছরে জনগণের ওপর এমন অত্যাচার, নির্যাতন করেছে, যার কোনো পূর্ব-দৃষ্টান্ত নেই। নির্বাচনকে প্রহসনে পরিণত করেছে। মানুষের মধ্যে ক্ষোভ ছিল, কিন্তু বিক্ষোভের সুযোগ ছিল না।
দ্বিতীয় স্বাধীনতার বিষয়টি আজগুবি
গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আসা পরিবর্তনকে দ্বিতীয় স্বাধীনতা বলা হচ্ছে। এটা একটা আজগুবি ব্যাপার। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ রাষ্ট্র তৈরি হলো, স্বাধীন হলাম আমরা। সেই অর্থে তো এটা দ্বিতীয় স্বাধীনতা নয়। এই গণ-অভ্যুত্থানের ফলে তো এখানে নতুন রাষ্ট্র তৈরি হয়নি।
দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম তার সাম্প্রতিক এক লেখায় শেখ হাসিনার অপশাসনের সঙ্গে শেখ মুজিবকে জড়ানো ঠিক হবে না বলে মন্তব্য করেছেন। শেখ মুজিবকে জড়িয়েছে কে? শেখ মুজিবকে জড়িয়েছে তাঁর মেয়ে। সব কিছুর সঙ্গে সে মুজিবকে জড়িয়েছে। শেখ মুজিবকে জড়িয়ে প্রোপাগান্ডা করেছে। এর ফলে বিক্ষোভ হয়েছে এবং এই বিক্ষোভ যে কেবল শেখ হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে হয়েছে তা নয়, এটি শেখ মুজিবের বিরুদ্ধেও হয়েছে।
৭ মার্চ, ১৫ আগস্টসহ সম্প্রতি যেসব দিবস বাতিল করা হয়েছে, সেটা ঠিক হয়েছে। ১৫ আগস্ট কেন ছুটি থাকবে? ইন্দিরা গান্ধী, রাজীব গান্ধী, আব্রাহাম লিংকনকে খুন করেছে, ছুটি আছে? এই দিবসে কর্মসূচি করতে পারে, কিন্তু জাতীয় দিবস হিসেবে ছুটি কেন?
মুজিব কিসের জাতির পিতা?
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিসের জাতির পিতা? এ দেশের জনগণ দুবার তাঁর (মুজিব) বিরুদ্ধে রায় দিয়েছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট তাঁকে হত্যা করার পর একজন লোকও তাঁর পক্ষে রাস্তায় আসেনি। স্বাধীনতার পর সাড়ে তিন বছরে শেখ মুজিব কী করলেন, যাঁর জন্য মানুষ এটা করল, তা হিসাব করতে হবে।
তাঁর (শেখ মুজিব) আসল পরিচয় পাওয়া যায় যখন ক্ষমতায় আসেন। তখন এই দেশের জনগণকে তিনি কী দিয়েছেন? তারপর গত ৫ আগস্ট সারা দেশের জনগণ শেখ মুজিবের মূর্তি ভেঙে ফেলল। তাঁর বাড়িতে আগুন দিল। এটা শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে একটা রায়।
ইউনূস সরকার উড়ে এসে জুড়ে বসেনি
ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার উড়ে এসে জুড়ে বসেনি। হাসিনার আওয়ামী লীগ সরকার উৎখাত হওয়ার পর একটা শূন্যতার সৃষ্টি হলো। এই শূন্যতা পূরণ করা দরকার ছিল। ছাত্র ও অন্যরা মিলে যদি এই সরকার দাঁড় না করাত, একমাত্র বিকল্প ছিল সামরিক সরকার। যারা এই সরকারের বিরুদ্ধে এখন বলছেন, তাঁরা কি বলবেন এর চেয়ে সামরিক সরকার ভালো ছিল? বিদ্যমান সংবিধান ফেলে দিয়ে নতুন সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। এমন একটা সংবিধান করতে হবে যা বর্তমান পরিস্থিতির সঙ্গে সামঞ্জ্যপূর্ণ।
অন্তর্বর্তী সরকারের সীমাবদ্ধতা আছে। শেখ হাসিনা যে শ্রেণির ওপর দাঁড়িয়ে রাজত্ব করেছে, সেই শ্রেণি আছে এখনো, উৎখাত হয়নি। বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী সেই শ্রেণির রাজনৈতিক দল।
ছাত্ররাজনীতি বন্ধের চেষ্টা পাগলামি
বর্তমান সরকার এমন কিছু করতে পারবে না, যাতে দেশের মানুষের অবস্থা পরিবর্তন হয়ে যায়। বিএনপি নির্বাচিত হলেও সব সমস্যার সমাধান করে দেবে না। বিএনপি আগে ক্ষমতায় ছিল, দেখেছি তারা কী করেছে। প্রকৃত বৈষম্যহীন সমাজ শ্রেণি সংগ্রাম ছাড়া সম্ভব নয়।
এই সরকার দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি ঠেকাতে পারছে না। দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি নিয়ন্ত্রণের একমাত্র উপায় হচ্ছে রেশনিং পদ্ধতি চালু করা। আর শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছাত্ররাজনীতি বন্ধের চেষ্টা পাগলামি। তা না করে আওয়ামী লীগ যে গুণ্ডামির রাজনীতি করেছে, তা বন্ধ করতে হবে।
Sharing is caring!